গল্প- গুপ্তশত্রু

গুপ্তশত্রু
– শান্তনু ব্যানার্জী

 

 

দুপুর পৌনে তিনটে। দেরি হয়ে গিয়েছে।জ্যোতিষরাজের চেম্বার সপ্তাহে দু’দিন খোলা। মঙ্গল আর শুক্র। দক্ষিণ কলকাতার এই জায়গায় দাপুটে লোকজনের বাস। আর এখানেই উনি হাত দেখে ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাবসা দাপটের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন। সাত্যকি সোমের আজ দ্বিতীয় দিনের সাক্ষাত্ হবে। প্রথম বার এসেছিল এক মাস আগে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজন ফর্সা অল্প টাক সমেত লাল সিল্কের কাপড় জড়ানো একজন মানুষের কথা। কপালে একটা লাল সিদুরের টিকা। দু’পাশে দু’টো করোটি। রিসেপশনে পৌঁছতে চেয়ারে বসে থাকা ছেলেটি জানিয়ে দিল আজ আর হবে না। বেলা একটা বেজে গেছে। শুনেই হঠাৎ তেড়ে ফুঁড়ে সাত্যকি এগিয়ে গেল চেম্বারের দিকে। দেখে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর পায়জামা পরে উল্টো দিকে মুখ করে উনি শুয়ে আছেন। এর মধ্যে ছেলেটি হাত ধরে টানাটানি করে বের করে নিয়ে যেতে চাইছে। কথাবার্তায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো জ্যোতিষরাজের। ছেলেটিকে বললো দশ মিনিট বাদে পাঠাতে। ঠিক দশ মিনিট বাদে গিয়ে দেখে সেই আগের মতো লাল কাপড়ে অভিষিক্ত হয়ে আছেন। বসতে বলার পরেই বললেন আপনার গুপ্ত শত্রু আছে । আপাতত একটা হীরের আংটি পড়তে হবে। সাত্যকির চোখে পড়লো ওনার দু’হাতে ভর্তি আংটি। জ্যোতিষরাাজও সময়ের হেরফেরে একটু দমে ছিলেন। এত আংটি পরে ওনার কি লাভ হয়েছে জিজ্ঞেস করায় বললেন, বাড়ি- গাড়ি কিছুই হয়নি। থাকেন হাবরাতে। বিভিন্ন জায়গায় চেম্বার করেন। এ যাত্রা কোনো পয়সা নিলেনই না। বললেন আর একদিন আসতে।
সাত্যকি সোমের কোনো দিনই হাত দেখানোর উপর কোনো বিশ্বাস ছিল না । মায়ের কোনো কথা না শুনলেও মায়ের মন রাখতে কয়েকবার এরকম লোকজনের কাছে যেতে হয়েছে। উপরন্তু মা আগে থেকেই পয়সা জোর করে সাত্যকির ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতেন। বেরিয়ে একটু দূরেই যুগলস’র মিষ্টির দোকান । দোকানে ঢুকেই একবার মায়ের কথা মনে পড়লো। ছোট বেলায় একবার স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে দেখে মা একটু বেরোচ্ছে। এক্ষুনি ফিরে আসবেন। সাত্যকিকে বললেন হাঁড়িতে মিষ্টি আছে খেয়ে নিতে। ফিরে আসতেই সাত্যকি জানাল সব মিষ্টি খেতে পারে নি। মায়ের চোখ ছানাবড়া। মাত্র চারটে মিষ্টি আছে। অথচ বাড়িতে লোকজন আসার কথা।
এরকমই আরেকবার সাত্যকি গিয়েছিল লিন্ডসে হোটেলে। লিফটে করে সাততলায় উঠে একটা রুমের সামনে দাঁড়াতে একজন লোক বললো, দুশো টাকা দিয়ে স্লিপ লিখিয়ে অপেক্ষা করতে। একজন বেরোলেই ঢুকতে পারবেন। এক মাসের জন্য উনি হোটেল রুম বুক করে রেখেছেন। চল্লিশ মিনিট বাদে একজন বেরোতেই ঘরে ঢুকে একদম ভ্যাবাচ্যাকা। ধুনোর ধোঁয়াতে অন্ধকার। চোখ জ্বালা করছে। পিতলের একটা লম্বা স্ট্যান্ডের উপর প্রদীপ জ্বলছে। তার পেছনে কালো, মোটা এবং কপালে চন্দনের তিলক কাটা এক বাবাজি বসে আছেন। দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছেন। চারদিকে দক্ষিণ ভারতীয় দেবতার ছবি। একটা হুঙ্কার দিয়ে সাত্যকিকে বললেন, তিনটে প্রশ্ন করতে। এরপর গুণ বিচার করে কি যজ্ঞ করা হবে এবং তার জন্য কত খরচ জানানো হবে। সাত্যকি বললো, বাবাজি মেরা একই প্রশ্ন হ্যায়। বাবাজি অভয় দিয়ে বললেন ‘বোল বেটা’ সাত্যকির প্রশ্ন ছিল ‘লাইফ ক্যায়সে চলেগা।’ প্রচণ্ড হুঙ্কার দিয়ে বাবাজি বললেন, ‘এ কই প্রশ্ন হ্যায়! প্রশ্ন হোনা চাহিয়ে কই গুপ্তশত্রু হ্যায় কি নেহি। প্রমোশন হোগা কি নেহি! অব ফরেন ট্রিপ কব হোগা!’ বললেন যা আজ ভাগ। দুসরা দিন আও ।
এতদিনে সাত্যকি এদের কাজ কারবার ভালোই বুঝেছে । গুপ্তশত্রুর কথা বলা মানে মনের একটা নেতিবাচক দিককে উস্কে দেওয়া। অনেকেই ভাবতে শুরু করে তাদের মধ্যে নিশ্চয় কোন গুণ আছে যা দেখে অন্যরা হিংসা করে এবং লুকিয়ে শত্রুতা করে।
আরেকবার ব্যারাকপুরে একজনের কাছে গিয়েছিল। সকাল আটটায় নাম লেখালে বিকাল চারটার পর সুযোগ পাওয়া যায়। নইলে আরও দেরী। তিনি কিছু প্রশ্ন করে যান। তার উত্তর দিতে হয়। তাঁর উপর আলোচনা চলে। এখানে সাত্যকি একটা কান্ড করে বসলো। যাই উনি বলেন, সাত্যকি সবই বলে মিলে যাচ্ছে। মানে যে কথা মেলেনি তাও সাত্যকি সায় দিয়ে গেছে। তাই মাইন্ড গেমের সুযোগ হয়নি। অগত্যা বলল আরেক দিন আসতে।
আরেকটা মজার ঘটনা। এক বন্ধু একজনের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে সাত্যকিকে বললো, যে আপনার স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে। এক্ষুনি সারবার উপায় নেই। লাগলে তুক না লাগলে তাক। লজ্জায় বন্ধু সাত্যকিকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
কিছুটা মজা করতে গিয়েই এসব করে এসেছে সাত্যকি। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে এরকম মজাও কাজে লেগে গেছে। যেমন একবার ট্রেনে করে ধানবাদে যাবার সময় এক ভদ্রলোক টিকিট কেটে উঠতে পারে নি। একদম সময় ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ যাবার পর চেকিং শুরু হোল। ভদ্রলোক খুব ভয় পেয়ে গেছেন। বেইজ্জতি হতে হবে। সাত্যকি দূর থেকে চেকারকে দেখেই বললো, সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু সাত্যকি সবার হাত দেখবে আর সবাইকে বলতে হবে যে সব মিলে যাচ্ছে। ব্যাস এটুকু হলেই চলবে। যথারীতি চেকার এল। সাত্যকি গভীর ভাবে হাত দেখায় ব্যস্ত। চেকার এসে পাশে বসে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল। সাত্যকি একঝলক ওনার দিকে তাকিয়ে বলল আজকে আমি একটাই কথা বলবো। পরে একদিন ভালো করে দেখে দেবো। গম্ভীর পরিবেশ। সাত্যকি বললো, আপনার একটা ব্রেন সার্জারি হয়েছে! ভদ্রলোক বললেন কি করে জানলেন! আপনি সত্যি আশ্চর্য মানুষ। আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবো। এই বলে কারও টিকিট চেক না করেই চলে গেল। রহস্যটা এবার জানা গেল। দূর থেকে ওনাকে দেখেই চিনতে পেরেছিল সাত্যকি। কারণ মাস ছয়েক আগে ওনাকে বলতে শুনেছিল ওনার অন্যান্য বন্ধুদের কাছে যে ওনার একটা ব্রেন সার্জারি হবে । সাত্যকি তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। সেটাই কাজে লেগে গেল।
এরকমই একটা ঘটনা আরেকবার ঘটে ছিল। একটা কোম্পানিতে একটা ডীল কিছুতেই কমপ্লিট হচ্ছিল না। একদিন সাত্যকি একটা ফাইলে অফিসের কাগজ পত্রের সাথে কিছু ফাঁকা হরস্কোপ নিয়ে গিয়েছিল। কথা চলাকালীন ফাইলের কাগজপত্র ইচ্ছাকৃতভাবে বের করে। কোম্পানির ম্যানেজার হরস্কোপ দেখে উৎসাহিত হয়ে পড়েন। সাত্যকি তৎক্ষনাৎ বিচার করে বললো, একটা বিরাট বড় প্রাপ্তিযোগ আছে। কিন্তু গুপ্তশত্রুতে আটকে আছে। সেটাও ব্যবস্থা করা যাবে। এই ডীলটাও কিন্তু সাইন হয়েছিল ।
এক্ষেত্রেও কয়েক মাস আগে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনেছিল যে ওনার একটা শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তির প্রাপ্তিযোগের কথা।
কোনো কথাই যায় না ফেলা।

Loading

Leave A Comment